হবিগঞ্জে রাস্তা ভেঙে ঢুকছে পানি, ভেসেছে ১০ সড়ক
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি :
উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে হবিগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে নবীগঞ্জ, মাধবপুর, লাখাই ও আজমিরীগঞ্জের বেশ কিছু গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। খোয়াই নদীর পানি কমতে শুরু করায় হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। অন্যদিকে নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কসহ ১০টি পাকা সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক। নতুন করে দক্ষিণ কসবা গ্রামের পাকা সড়ক ভেঙে দ্রুত গতিতে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়রা জানায়, খোয়াই নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় খোয়াই নদীর পানি চুনারুঘাটের বাল্লা পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার, শায়েস্তাগঞ্জ পয়েন্টে ৩০৩ সেন্টিমিটার ও হবিগঞ্জের মাছুলিয়া পয়েন্টে ১০৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কুশিয়ারার পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ২১, বানিয়াচংয়ের মার্কুলি পয়েন্টে ৩৩ ও আজমিরীগঞ্জে ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরে উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে নবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এতে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের রাজনগর, উমরপুর, মোস্তফাপুর, দক্ষিণগ্রাম, পাঠানহাটি, মনসুরপুর, দরবেশপুর, দিঘীরপাড়, নোয়াগাঁও, চন্ডিপুর, প্রজাতপুর, লামলীপাড়, দীঘলবাক ইউনিয়নের রাধাপুর, ফাদুল্লাহ, দুর্গাপুর, মথুরাপুর, হোসেনপুর, মাধবপুর, পশ্চিম মাধবপুর, গালিমপুর, আউশকান্দি ইউনিয়নের পাহাড়পুর,পারকুল, উমরপুর, দীঘর ব্রাহ্মণগ্রাম, বড় ভাকৈর (পশ্চিম) ইউনিয়নের সোনাপুর, চরগাঁও, বড় ভাকৈর (পূর্ব), করগাঁও, কালিয়াভাঙ্গা, দেবপাড়া ও কুর্শি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কসহ ১০টি পাকা সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা ইনাতগঞ্জ ও দীঘলবাক ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরবাড়িতে প্রবেশ করেছে। ফলে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছে সাধারণ মানুষ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এমন অবস্থায় বন্যাকবলিতরা আশ্রয়কেন্দ্র ছুটছে। ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর দীঘলবাক ইউনিয়নের দক্ষিণ কসবা গ্রামের পাকা সড়ক ভেঙে দ্রুতগতিতে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। এতে মানুষ আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় জীবনযাপন করছেন। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ইনাতগঞ্জ অবস্থিত শেভরন পরিচালিত এশিয়া মহাদেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা ও পারকুলে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী ঘেঁষা বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। বিবিয়ানা গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ৪-৫ ফুট নিচে বর্তমানে পানি রয়েছে। তবে দ্রুতহারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রে পানি প্রবেশের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
বুধবার বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় জালালাবাদ এলাকায় খোয়াই নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিলে জালালাবাদসহ আশপাশের এলাকায় প্রবেশ করে। বৃষ্টির পানিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সার্কিট হাউস, অনন্তপুর, মাহমুদাবাদ, শ্যামলী, চৌধুরী বাজার এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় ও খোয়াই নদীর পানি কমতে শুরু করায় হবিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে।
অপরদিকে জেলার মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া ইউনিয়নের হরিশ্যামা গ্রামের মরারচর এলাকায় সোনাই নদীর বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেছে। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে বাড়িঘর, কৃষি জমি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া লাখাই ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ধানের জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা সরেজমিনে নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, ইনাতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র ও দীঘলবাক ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শন করেছেন।
ইনাতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া রফিক মিয়া বলেন, বন্যার পানিতে বাড়িঘর শেষ, ঘরে কোমর সমান পানি। পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি, কিন্তু এখনও কোনও সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
এই আশ্রয়কেন্দ্রে আসা সোহেনা বেগম বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খাবার কিচ্ছু নেই। অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছি।
শেভরন বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বলেন, বন্যার পানি যাতে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে প্রবেশ না করে এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। পানি
প্রবেশের কোনও শঙ্কা নেই।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম দাশ অনুপ জানান, বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। ১৪টি সরকারি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রয়েছে, এরমধ্যে ৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, খোয়াই নদীর পানি কমছে, ফলে অনেক স্থানে পানি নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কুশিয়ারা ডাইক মেরামতের জন্য সরকারিভাবে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। নদীর বাঁধ রক্ষায় চার হাজার জিও ব্যাগ ও ১২ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ মজুদ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত বুধবার ২৪ ঘণ্টায় ১১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তবে বৃহস্পতিবার গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬৭ মিলিমিটার।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক জিলুফা সুলতানা বলেন, বন্যাকবলিত মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন, তাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। আমরা সবসময় বন্যার্ত মানুষের পাশে আছি।