reorder disabled_by_default

পবিত্র শবে বরাতের তাৎপর্য, শিক্ষা ও করণীয়

Update : 25 Feb 2024 - 3:49 PM    |     পঠিত হয়েছে: 61 বার
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তাৎপর্যবহুল একটি দিবস শবে বরাত। বরাতের রাত বা ভাগ্যের রজনী হিসেবে পরিচিত এই দিনটি পালিত হয় আরবি বর্ষের শাবান মাসের ১৫ তারিখে। এর পটভূমিতে রয়েছে মূলত দিবাগত রাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মাহাত্ম্য যথেষ্ট প্রভাব রাখে ইসলামী জীবন ধারা চর্চায়। এ রাতে মহান আল্লাহ অতীতের পাপ-পঙ্কিলতা শুধরে নিয়ে আগামী দিনগুলো নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেন। আর তাই এক নিষ্পাপ জীবনের প্রত্যাশায় বিগত কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ। চলুন, মহিমান্বিত এই সময়ে পবিত্র শবে বরাতের তাৎপর্য, শিক্ষা ও করণীয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।
শবে বরাতের তাৎপর্য
এই রাতে নির্ধারিত হয়েছিল প্রতিটি মানুষের জীবনের শুরু ও শেষ দিনটি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ্য বিধাতা আল্লাহ তায়ালা এই রাতে মানুষকে তার জীবনের যাবতীয় পাপ মোচনের সুযোগ দেন। এর মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জন্য নতুন করে জীবন রচনার এক অভাবনীয় দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাই এই রাতকে ক্ষমা ও মুক্তির রাতও বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ১৫ শাবানের রাতের কথা না থাকলেও নানা হাদীসগ্রন্থে এর বিভিন্ন ব্যাখা পাওয়া যায়।
বায়হাকী হাদিস অনুসারে, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তার স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) কে ১৫ শাবানের গুরুত্ব বোঝাচ্ছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, কোন মানুষ কোন সময়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কোন সময়ে মারা যাবে তা এই রাতে নির্ধারণ হয়। তাই এই সময় মানুষের কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ হয় এবং তাদের রিজিকের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে তাদের জন্য খোলা থাকে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের সমস্ত দরজা।
ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী হাদিসে আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) এর বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর বাণীতে উঠে আসে শবে বরাতের তাৎপর্য।
এখানে মুহাম্মদ (সাঃ) শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে সারা রাত জেগে নামায পড়তে আর দিনের বেলা রোযা রাখতে বলেছেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা সূর্যাস্তের পর থেকে ফজরের সময় পর্যন্ত দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়া দেন। এ সময় তিনি যার রিযিক দরকার তাকে রিযিক দেন এবং বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদমুক্ত করেন।
উমর ইবনে আবদুল আজিজসহ অন্যান্য ইসলামী পন্ডিতগণ বছরের চারটি রাতকে অবহেলা করতে নিষেধ করেছেন। কেননা রাতগুলোতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন।
এগুলো হচ্ছে- রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৫-তম রাত, ঈদুল ফিতরের আগের রাত এবং ঈদুল আজহার আগের রাতে।
পবিত্র শবে বরাতের শিক্ষা
সত্যিকারের অনুতাপ
এই বিশেষ রাত পূর্বের ভুল-ভ্রান্তির জন্য সত্যিকার অর্থে অনুতপ্ত হতে শেখায়। এই অনুতাপ ভবিষ্যতে কোনো ভুল করার সময় এই রাত্রির কথা মনে করিয়ে দেবে। ফলে এক রকম দায়বদ্ধতার তৈরি হবে, যা জীবনকে পরিচালিত করতে পারে পূণ্যের পথে।
ক্ষমা করার মনোভাব
সমূহ পাপাচারের পরেও যে মন থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহর তাকে ক্ষমা করেন। আর এই বিষয়টি প্রতিটি মানুষকে অন্তরের ঘৃণা দূর করে পরস্পরকে ক্ষমা করতে শেখায়। এই শিক্ষা প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও রাগের মত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষকে দূরে রাখে।
ইবাদত
ইসলামের বিভিন্ন ধর্মীয় দিবসগুলোর মত শবে বরাতও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। ছোট জীবনে যত বেশি ইবাদত করা যায়, পাপ কাজ থেকে ততটাই দূরে থাকা যায়। শুধু তাই নয়, এভাবে সার্বক্ষণিক ইবাদতের মধ্যে থাকা একসাথে দুইটি ক্ষেত্রে সুফল দেয়। এক, এভাবে তওবার মধ্যে থাকলে আল্লাহ যদি চান অতীতের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেবেন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি ইবাদতই আল্লাহর কাছে দোয়া করা। এভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা গেলে, এই দোয়াই হবে ভবিষ্যতে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির উপায়।
মৃত্যুকে স্মরণ করা
এই জীবন ও মৃত্যুর নির্ধারণী দিনের কথা মনে এলেই স্মরণে আসবে যে এই ভবলীলার সবকিছুই একদিন শেষ হবে। তাই সীমাহীন ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে গেলেও এখানে অহংকারের অবকাশ নেই। একই রকম অনুভূতি হবে প্রিয়জনদের কবর জিয়ারতের সময়। এই কবরে প্রত্যেককেই যেতে হবে। আর এই চিন্তা পৃথিবীতে মিথ্যার প্রলোভনে পড়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে।
তওবা ও দোয়া করা
অতীতের যাবতীয় গুণাহ থেকে মাফ পাওয়ার একমাত্র উপায় হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করা। বছরের প্রতিটি দিন আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য এই বিশেষ দিনটি হচ্ছে মুসলমানদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সঠিক ভাবে দোয়ার অনুশীলনে সম্ভাবনা বাড়ে অনাগত দিনগুলোতে আল্লাহর রহমতের মধ্যে বেঁচে থাকার। ফলে মুক্তি মেলে রোগ-শোক, দুঃখকষ্ট ও বিপদ-আপদ থেকে।
ক্ষমা করার চর্চা করা
ঈদের দিনে পুরনো রাগ-ক্ষোভ ভুলে সবাই আবার পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রাখতে শুরু করে। শবে বরাতেও সেভাবে নতুন ভাবে শুরু করা যেতে পারে মানুষকে ক্ষমা করার চর্চা। এতে করে সমাজে ইতিবাচকতা ছড়ায়। ঘনিষ্ঠজনদের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। সর্বপরি, পরিতৃপ্তির এক জীবন পরিচালনা করা যায়।
কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে জ্ঞানার্জন
শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা যেতে পারে কোরআন ও হাদীস। কোনও একটি নির্দিষ্ট সমস্যার প্রতি আলাদা ভাবে দৃষ্টিপাত করে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তার সমাধানগুলো খুঁজে বের করা যেতে পারে। এভাবে যত বেশি জ্ঞানার্জন করা যাবে, সেই সমস্যা সম্পর্কে তত বেশি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যাবে। এর জন্য কোরআন-হাদীস ছাড়াও বিভিন্ন প্রমাণসিদ্ধ ইসলামী বই পড়া যেতে পারে।
সঠিকভাবে ইবাদতের চেষ্টা
যারা নিয়মিত ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলেন তাদের মধ্যে অনেকেরই অনেক ক্ষেত্রে ইবাদতের ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়ে সন্দেহ থাকে। এক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদতের যথার্থতা নিয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেন না। এই ঘাটতিগুলো পূরনের জন্য এই বিশেষ দিবসটি উপযুক্ত হতে পারে। কেননা এ সময় প্রায় প্রতিটি মুসলমানের মধ্যেই ইবাদতের বিশেষ করে নফল নামায পড়ার ঝোঁক থাকে। নামায পড়ার সময় বায়োজ্যেষ্ট বা যিনি ধর্ম সম্পর্কে তুলনামুলক ভাবে বেশি জ্ঞান রাখেন তার কাছ থেকে শিখে নেয়া যেতে পারে।
এছাড়া শবে বরাত রমজানের জন্যও এক রকম প্রস্তুতি বটে। কঠিন প্রশিক্ষণের আগে হাল্কা মহড়ার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে নেয়া যায়।
নামায ও রোযা পালন
নবী (সাঃ) তরিকা অনুযায়ী রাতে নফল নামায এবং দিনে রোযা রাখা যেতে পারে। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে, এই ঐচ্ছিক ইবাদত পালন করতে যেয়ে যেন অবশ্য পালনীয় ইবাদতগুলো নষ্ট হয়ে না যায়। নফল নামাযের ক্ষেত্রে যথার্থ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে তা পড়া হলো কিনা তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কত বেশি পড়া হলো সে সংখ্যাটা মূখ্য বিষয় নয়।
মৃতজনদের জন্য দোয়া করা
জীবদ্দশায় অনেক ধন-সম্পদ উপার্জন করা গেলেও মৃত্যুর পর তার কিছুই উপকারে আসে না। যা উপকারে আসে তা হচ্ছে পৃথিবীতে তার আমল এবং রেখে যাওয়া প্রিয়জনদের দোয়া। দুনিয়ায় মানুষের কোনও কল্যাণ করে গেলে তার বিনিময়ের সেই মানুষগুলোর দোয়া পরকালে সিদ্ধি লাভের সহায়ক হয়। তাছাড়া কবরদেশের আযাব যন্ত্রণাও লাঘব হয় এই দোয়ার মাধ্যমে। আর এ জন্যেই মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ) আবেগাপ্লুত হয়ে দোয়া করতেন মা-বাবার জন্য।
এই কবর জিয়ারত মৃত্যুভয় জাগানোর মাধ্যমে অনেক বড় প্রভাব ফেলে পার্থিব জীবনে। এই মৃত্যু ভীতি অহেতুক সময় নষ্ট করার প্রবণতা কমিয়ে দেয়।
পরিশেষে
পবিত্র শবে বরাতের তাৎপর্য ও শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে করণীয়গুলো যথাযথ ভাবে পালনের মাঝেই পঙ্কিলতা মুক্ত জীবন দর্শন নিহিত। এতে কোনও বিতর্ক বা মাত্রাতিরিক্ত জোরারোপের অবকাশ নেই। ধর্মীয় দিক থেকেও এখানে কোনও বাধ্য-বাধকতা নেই। কিন্তু পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এখানে মূখ্য। এর চর্চা যত বেশি হবে ততই সম্ভব হবে তা জীবনে ধারণ করা। আর সেই পূণ্যবান জীবন গঠনই শবে বরাতের মত ধর্মীয় রীতিগুলোর মূলমন্ত্র।

এই বিভাগের আরও খবর